– আবদুল নবী 

আইন আছে অহরহ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে অসীম। তারপরও বর্তমানে একের পর এক যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা এবং এ সংক্রান্ত ঘটনা জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে। এক ভয়ংকর মহামারী রূপে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে সমাজে। প্রতিদিন খবরের কাগজ হাতে নিলে দেখা যায় নরপিশাচরা যে নির্মমভাবে ধর্ষণ করেছে সেই দৃশ্য। কাঁদিয়ে তুলে হৃদয়কে।

যতই দিন যাচ্ছে ততই এই আতঙ্ক বোধ বেড়েই চলছে গাণিতিক হারে কিংবা জ্যামিতিক হারে। ফেসবুক, টুইটার,হোয়াটসআফ, অনলাইন নিউজ সাইট, ব্লগ সাইট ইত্যাদিতে ইদানিং শুধু এই ধর্ষণের খবর আর খবর। এই পশুর শ্রেণীর পাশবিক অমানুষগুলো তাদের আবেগী তৃপ্তি মেটাতে গিয়ে ছাড়তেছে না শিশুদেরকেও। একটু আবেগের অনুভূতি নিয়ে আজ সমাজে এই ধর্ষকরা যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে তাতে সমাজের কেউই নিরাপত্তা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। একসময় এই ধর্ষণকে যুদ্ধের মরণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো। কিন্তু আজ তা বদলে গিয়ে পরিণত হয়েছে ভোগের বস্তুতে।

বর্তমানে যেভাবে ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিগত বছরগুলোতে তা নগণ্য ছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ জন নারী ধর্ষিত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসে। প্রতিমাসে ১৫০ থেকে ২০০ এর অধিক ধর্ষিতাকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে সেখানে। কিন্তু এই সংখ্যায় প্রকৃত ধর্ষণের সংখ্যা নয়। এর বাইরে লোক লজ্জার ভয়ে নিরবে চুপ করে আছেন হাজার হাজার নারী। যা কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে “বর্তমান বিশ্বের মোট নারীর একতৃতীয়াংশ সরাসরি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অহরহ।

এক রিপোর্টে ঢাকার ডি.সি. জানান, ” জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন থানায় ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়েছে ৫৫৪ টি। রাস্তা থেকে অপহরণ করে গাড়িতে ধর্ষণ করার মামলা রয়েছে কয়েকটি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি এটাই সত্য? দিনের পর দিন ধর্ষণ হচ্ছে আমার মা-বোন-সন্তানেরা। যা আজ গণনার বাইরে। অথচ এরা বলতেছে মামলা নয় অভিযোগ করা হয়েছে ৫৫৪ টি। কি আজব আমার দেশের নিয়ম! ভাবতে আজ কষ্ট হচ্ছে স্বাধীনতা নিয়ে। আইনজীবী সমিতির এক রিপোর্ট থেকে জানতে পারলাম ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন। আসল কথা হলো এই রিপোর্ট কিসের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে সেটা। এটা শুধু পত্রিকায় ছাপানো খবর থেকে সংগ্রহ করে তারা রিপোর্ট করে। কিন্তু বাস্তবিক হলো ধর্ষণের পর নিজের মানসম্মান, ইজ্জত, লোকলজ্জার ভয়ে মুখ বন্ধ করে ঘরের চারদেয়ালে কান্না করতেছে অগণিত ধর্ষিত নারী।

শুধু যে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই মহামারী বিরাজমান তা কিন্তু নয়। এটা বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোতেও ঘটতেছে জ্যামিতিক হারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মতে বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ যেকোন সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যা আজ নারীদের জন্য আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে শতকরা ৩৩জন ধর্ষণের শিকার হয়। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতি ৪জনের মধ্যে ১জন পুরুষ একবার হলেও ধর্ষণ করে এবং কোন আইনি ঝামেলা পোহাতে হলো না।(জরিপ ২০১৩)

আমরা প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মিডিয়াতে ধর্ষণের যে খবর দেখি তা মূলত বাইরের অপরিচিত লোকদের দ্বারা ঘটে। কিন্তু এর বাইরে চাপা পড়ে থাকে পরিচিতদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার ইতিহাস। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট ২০১৩ এর মতে ১০০জন ধর্ষিত নারীর ৯৮ জন ধর্ষিত হয় পরিচিত জনের দ্বারা। যা প্রকাশ পায় না। চাপা পড়ে থাকে ডাস্টবিনের সর্বনিম্ন স্থানে। অনেকেই ধর্ষণের কারণ বলতে গিয়ে নারীদের চলাচল, পোশাক পরিচ্ছদকে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এগুলো ছাড়া যে বিষয়টা সবার অজানা এবং লুকানো সেটা হলো কু-চিন্তা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে নারীকে দমিয়ে রাখা। কারণ যদি পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী হয় তাহলে এতো পরিমাণে শিশু ধর্ষিত হতো না? ছোট্ট অবুঝ শিশু কি বুঝে পোশাক নিয়ে যে তাকেও ধর্ষণ করা হচ্ছে এবং এরপর হত্যা করা হচ্ছে।

বর্তমানে ১ লক্ষ ৫০ হাজার মামলা ঝুলে আছে। কোন তদন্ত নেই। এর জন্য কোন রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যার কারণে অপরাধী ভয় না পেয়ে সাহস পাচ্ছে এই কাজ করতে। প্রতি বছর মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে ৩.৬৬% এবং সাজা পাচ্ছে প্রতি হাজারে ৪ জন। আরো বিশদভাবে বলতে গেলে ২০০১-১৫ পর্যন্ত ২২৩৮৬ জন ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসার জন্য আসে। তার মধ্যে ৫ হাজার মামলা হয়েছে। রায় ঘোষণা করছে ৮০২ টির এবং শাস্তি পেয়েছে মাত্র ১০১ জন। রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬% এবং সাজার হার ০.৪৬%। এখন প্রশ্ন হলো ২২৩৮৬ জন থেকে ৫ লক্ষ মামলা হলো। কিন্তু বাকিগুলো কি হয়েছে? ৫ লক্ষ থেকে মাত্র ৮০২ টা মামলার রায় দেওয়া হয়েছে যেখানে শাস্তি দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০১ জনকে। তাহলে কি ঐ ধর্ষিতার ঘটনা মিথ্যে ছিলো নাকি ধর্ষক অপরাধী ছিলো না? আসলে এর জন্য আমার দেশের আইন দায়ী। দায়ী আমরা। আইনের সঠিক তদন্তে ত্রুটি থাকায় আজকে স্বাধীন বাংলার মা-বোনেরা নিরাপদ নয় তাদের ইজ্জত নিয়ে।

এই অমানুষ ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পায় নি ১ বছর ৮ মাস বয়সের শিশু কিংবা ৬০ এর উর্ধ্বের মহিলারাও। ২০১৮ সালের ১-১৮ বছর বয়সী ধর্ষিতের সংখ্যার মধ্যে ১-৬ বছরের শিশু ছিল ১৫ জন। কি বুঝতো এই ছোট্ট মেয়েগুলো। ৫ বছরের সেই অবুঝ শিশু খেলতে গিয়ে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারলো না তার বাবা-মার কাছে। ৮ বছরের তিষাও পারলো না সুন্দরভাবে বাঁচতে। ধর্ষণের পর হত্যা করে বস্তা ভরে গর্তে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো। কি তাদের দোষ ছিল? তারাও কি অশালীন পোশাক পরিধান করতো? নাকি কুলাঙ্গারদের কু নজর থেকে রেহাই পায় নি?

২০০১-১৮ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১৩৬৩৮ টি যার মধ্যে গণধর্ষণ ছিল ২৫২৯টি। ২০১৯ সালের এই পর্যন্ত ধর্ষণ হয়েছে ৬৯২৭ জন শিশু যা জ্যামিতিক হারকেও পরাজিত করে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪৬৭ জনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ১৫৪ জন। যার কারণে আজ শান্তিতে ঘুমানো সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চশিক্ষিত মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে চলন্ত বাসে কিংবা ছোট্ট অবুঝ শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ঘরের চারদেয়ালে । নাই কোন নিরাপত্তা আজ। ধর্ষক তাদের অপরাধের শাস্তি পাচ্ছে না বলে এই অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলছে অনবরত।

এ কোন সমাজে আমরা বাস করি? ছোট্ট শিশু ১ বছর ৮ মাস যার বয়স তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। বাড্তায় ৩ বছরের শিশু ধর্ষণ এবং উত্তরায় ৪ বছরের শিশু ধর্ষণ। এরাতো ছোট্ট শিশু। অবুঝ। বুঝে না কোন পোশাকের শালীনতা। অথচ তারাও নিরাপত্তার মধ্যে নাই। এ কোন মানব সমাজে আমরা বাস করি? এখনই সোচ্চার হোন, আওয়াজ তুলুন। মনে রাখবেন, আপনি আমি কেউই এই সমাজের বাইরে না। আপনার আমার মা, বোন এই সমাজে বাস করে। যদি সুষ্ঠু বিচার করতে না পারেন তাহলে আপনার আমার পরিবার নিরাপত্তাহীণতায় ভোগবে।

এটা আসলে কেন হচ্ছে? এর জন্য কারা দায়ী? কী করে ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব? ধর্ষিত নারীদের কি করা উচিত? এসব প্রশ্ন নিয়ে যথার্থ আলোচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশকে এই ভয়ংকর মহামারী থেকে রক্ষা করতে হবে। নিজ মা-বোন- সন্তানদের সম্ভ্রম লুণ্ঠনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। একটা ধর্ষণের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটা ধর্ষণ। এভাবেই বেড়েই চলতেছে এই অসামাজিক ঘৃণিত ছোঁয়াচে রোগটা। সরকার মহলের উচিত ঘটনাকে চাপা না দিয়ে তাৎক্ষণিক তার সঠিক বিচার করা। অপরাধীকে কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি প্রদান করা। যাতে আর কেউ এই কাজ করতে সাহজ না পায়। আমি বলবো চলন্ত বাসে রূপার ধর্ষণের য়েমন তাৎক্ষণিক বিচার করা হয়েছিল সেভাবে বিচার করতে হবে। যেভাবে রুপার ধর্ষকদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল সেভাবে শাস্তি দেওয়া হোক। বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি এবং সততার সাথে

আবদুল নবী ,শিক্ষার্থী ,কক্সবাজার সিটি কলেজ

আইনের কাজ করতে চাপ দেওয়া হোক যাতে অপরাধী গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরতে না পারে।

সর্বোপরি আমাদের সচেতন হতে হবে। পরিচিত কারো কথায় অচেনা অজানা কোন জায়গায় কৌতুহল নিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। অন্যায়কে আশ্রয় না দিয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হয়ে মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করুন এবং অপরের মা-বোনদেরকেও রক্ষা করুন। দেখবেন আপনার মা-বোন এমনিতেই নিরাপদ থাকবে।